হিজরত : দ্বীনকে বিজয়ী করার সূচনা পর্ব
আহমদ বদরুদ্দীন খান
সম্পাদক : মাসিক মদীনা
মক্কার কাফেররা যখন জানতে পারল যে, তাদের প্রধান বাণিজ্যস্থল শাম মুলুকে যাওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ জনপদ
ইয়াস্রাবে মুসলমানদের একটি নতুন শক্তিকেন্দ্র গড়ে উঠেছে
এবং উৎপীড়িত মুসলমানগণ একে একে সেখানে গিয়ে সমবেত হচ্ছে, এমন কি খোদ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কেও
তারা সেখানে নিয়ে যেতে চাচ্ছে, তখন ওদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে গেল!
কেননা, স্থানটি ছিল তাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র সিরিয়ায় যাওয়ার পথেই অবস্থিত।
তাই ওরা তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল- না, তাঁকে কিছুতেই সেখানে যেতে দেওয়া হবে না।
বরং তাঁকে হত্যা করে সকল ঝামেলা একবারেই চুকিয়ে দেওয়া হবে।
আল্লাহ্ পাক দুশমনদের এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাঁর প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অবহিত করলেন এবং
নির্দেশ দিলেন মক্কা ছেড়ে মদীনার পথে হিজরত করতে।
সে মতে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষের পহেলা রবিউল আওয়াল রাতে মক্কা থেকে রওনা হয়ে
আটই রবিউল আওয়াল তারিখের মধ্যাহ্ন বেলার ঠিক আগ মুহূর্তে
মদীনা মুনাওয়ারার উপকণ্ঠে অবস্থিত ‘কোবা’ নামক পল্লীতে এসে উপনীত হলেন।
আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতকালে মক্কা থেকে যে পথ অতিক্রম করে মদীনা মুনাওয়ারায় পৌছেন
সে পথ পরিক্রমার উল্লেখযোগ্য মনযিল তথা
স্থানসমূহ সম্পর্কে হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়ের (রা.) স্বীয় খালা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন :
عَنْ عُرْوَةَ بْنِ الزُّبَيْرِ، عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ
: ্রلَمَّا خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الْغَارِ مُهَاجِرًا
وَمَعَهُ أَبُو بَكْرٍ، وَعَامِرُ بْنُ فُهَيْرَةَ، مُرْدِفُهُ أَبُو بَكْرٍ
وَخَلْفَهُ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ أُرَيْقِطٍ اللَّيْثِيُّ فَسَلَكَ بِهِمَا أَسْفَلَ مِنْ مَكَّةَ، ثُمَّ مَضَى
بِهِمَا حَتَّى هَبَطَ بِهِمَا عَلَى السَّاحِلِ أَسْفَلَ مِنْ عُسْفَانَ، ثُمَّ اسْتَجَازَ بِهِمَا عَلَى أَسْفَلَ أَمَجَ، ثُمَّ عَارَضَ الطَّرِيقَ بَعْدَ أَنْ أَجَازَ
قُدَيْدًا، ثُمَّ سَلَكَ بِهِمَا الْحِجَازَ، ثُمَّ أَجَازَ بِهِمَا ثَنِيَّةَ الْمِرَارِ، ثُمَّ سَلَكَ بِهِمَا الْحَفْيَاءَ،
ثُمَّ أَجَازَ بِهِمَا مُدْلِجَةَ لِقْفٍ، ثُمَّ اسْتَبْطَنَ بِهِمَا
مُدْلِجَةَ مَجَاحٍ، ثُمَّ سَلَكَ بِهِمَا مَذْحِجَ، ثُمَّ بِبَطْنِ مَذْحِجَ مِنْ ذِي الْغُصْنِ، ثُمَّ بِبَطْنِ ذِي كَشْدٍ، ثُمَّ أَخَذَ الْجُبَاجِبَ، ثُمَّ سَلَكَ ذِي
سَلْمٍ مِنْ بَطْنٍ أَعْلَى مُدْلِجَةَ، ثُمَّ أَخَذَ الْقَاحَةِ ثُمَّ هَبَطَ الْعَرْجِ،
ثُمَّ سَلَكَ ثَنِيَّةَ الْغَائِرِ، عَنْ يَمِينِ رُكُوبِهِ، ثُمَّ هَبَطَ بَطْنَ رِيمٍ فَقَدِمَ
قُبَاءَ عَلَى بَنِي عَمْرِو بْنِ عَوْفٍগ্ধ هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ عَلَى شَرْطِ مُسْلِمٍ وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ (مُسْتَدْرَك الحَاكِم فِيْ كِتَابِ الهِجْرَةِ : ٤٢٧٢)
“আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত আবু বকর (রা.)-সহ
মক্কার গারে সূর থেকে বের হয়ে মদীনা মুনাওয়ারার উদ্দেশে হিজরতের জন্য যাত্রা শুরু করলেন।
এক উটে স্বয়ং নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরোহণ করলেন ও অপর উটে হযরত আবু বকর (রা.) তাঁদের পথ প্রদর্শক
আমের ইবনে ফুহাইরাহ্ ও খাদেম আবদুল্লাহ্ ইবনে উরাইকিত আল লাইসীকে নিয়ে মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন।
কিছু দূর যাওয়ার পর তাঁরা (মক্কা থেকে আনুমানিক সত্তর মাইল দূরত্বে অবস্থিত) উসফানের নিম্নভূমিতে গিয়ে পৌছুলেন।
অতঃপর সেখান থেকে আরো সামনে আগ্রসর হয়ে ‘আমাজ’ নামক স্থানে গিয়ে পৌছুলেন।
এরপর আরো কিছু দূর অগ্রসর হয়ে ‘কুদাইদ’ নামক স্থান অতিক্রম করার পর তাঁরা (তৎকালীন মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী যাতায়াতের পরিচিত)
পথের এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলে গেলেন।
অতঃপর হেজাযের বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চল অতিক্রম করে ‘সানিয়্যাতুল মিরার’ নামক স্থানে পৌছুলেন। অতঃপর সেখান থেকে ‘হাফইয়া’ নামক স্থানে পৌছুলেন।
এরপর আরো কিছু দূর অগ্রসর হয়ে ‘মুদলিজা’ নামক স্থানে পৌছুলেন।
অতঃপর সেখান থেকে ‘মুদলিজা’র বক্ষ অতিক্রম করে ‘মুদলিজা মাজাহ্’ নামক স্থানে পৌছুলেন।
অতঃপর সেখান থেকে ‘মায্হিজ’
নামক স্থানে পৌছুলেন।
অতঃপর ‘মাযহিজ’ অঞ্চলের মাঝ বরাবর চলতে চলতে এক সময় এসে ‘যী-গুস্ন’ নামক স্থানে এসে পৌছুলেন।
অতঃপর সেখান থেকে
‘যী-কাশ্দ’ উপত্যকায় পৌছুলেন।
অতঃপর সেখান থেকে ‘জুবাজিব’ ও ‘যী-সিল্ম’ নামক স্থান অতিক্রম করে ‘মুদলিজা’র উচ্চভূমিতে এসে পৌছুলেন।
অতঃপর ‘আল ক্বাহা’ নামক স্থান অতিক্রম করে
‘র্আজ’ নামক স্থানে এসে অবতরণ করলেন।
অতঃপর সেখান থেকে ‘সানিয়্যাতুল গায়ের’ নামক উপত্যকা অতিক্রম করে ডান দিকে
অগ্রসর হয়ে ‘রীম’ উপত্যকায় এসে পৌছুলেন।
অতঃপর সেখান থেকে পাক মদীনার নিকটবর্তী উচ্চভূমি হিসেবে পরিচিত
‘আলীয়া’ বা ‘কোবা’ নামক অঞ্চলে পৌছে বনী আমর ইবনে আউফ গোত্রের আঙ্গিনায় এসে অবতরণ করলেন।” (মুস্তাদরাক হাকেম, কিতাবুল হিজরাহ্ : ৪২৭২)
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পূর্ব থেকেই তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতী যিন্দেগীর এই গুরুত্বপূর্ণ সফরের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে
তাঁর যাপিত জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু হযরত আবু বকর (রা.)-কে মনোনীত করে রেখেছিলেন।
আর তাই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মনের একান্ত ইচ্ছা গোপন রেখে এ সম্পর্কে ঐশী অভিপ্রায় কি,
তা হযরত জিবরাঈল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করামাত্র মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তাই নির্দেশ করা হয়,
যা তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কামনা করেছিলেন।
হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) বর্ণনা করেন :
عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِجِبْرِيلَ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ
: “مَنْ يُهَاجِرُ مَعِي؟ قَالَ : أَبُو
بَكْرٍ الصِّدِّيقُ ্রهَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ وَالْمَتْنِ وَلَمْ يُخَرِّجَاهُগ্ধ (مُسْتَدْرَك الحَاكِم فِيْ كِتَابِ الهِجْرَةِ : ٤٢٦٦)
“রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের পূর্বে হযরত জিবরাঈল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, কে আমার হিজরতকালীন সফর সঙ্গী হবে? হযরত জিবরাঈল (আ.) বললেন, হযরত আবু বকর (রা.)।”
(মুস্তাদরাক হাকেম, কিতাবুল হিজরাহ্ : ৪২৬৬)
হিজরতের সূচনা
বাইআতুল-আকাবায় মদীনাবাসীর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ পেয়ে কাফের কোরায়েশরা রাগে ও ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল,
এবং মুসলমানদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল।
এহেন পরিস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবায়ে-কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের পর্যায়ক্রমে মদীনায় হিজরত করার পরামর্শ দিলেন।
সেমতে সাহাবায়ে-কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম আস্তে আস্তে একজন দু’জন করে গোপনে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করাও শুরু করলেন।
অবশেষে মক্কায় রাসূলে করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম),
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হযরত আলী (রা.) ও অল্পসংখ্যক সক্ষম মুসলমান ছাড়া কোন ঈমানদার ব্যক্তি বাকী রইল না।
হযরত আবু বকর (রা.)-ও হিজরতের ইচ্ছা করেছিলেন; কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বললেন :
আল্লাহ্ তা’আলা আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সেমতে তিনি এই অপেক্ষায় রইলেন।
এ সফরের জন্যে তিনি দু’টি উষ্ট্রীও যোগাড় করে রেখেছিলেন। একটি নিজের জন্যে, অপরটি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্যে।
(সীরাতে ইবনে-হিশাম)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরত
পরিস্থিতি অবগত হয়ে কাফের কোরায়েশরা পরামর্শের জন্যে দারুন-নাদওয়ায় সমবেত হল।
কেউ তাঁকে ব¬ন্দী করার পরামর্শ দিল, এবং কেউ নির্বাসনের পক্ষে মত প্রকাশ করল।
কিন্তু তাদের ধূর্ত লোকেরা বলল : এটা ঠিক নয়। কেননা, তাঁকে বন্দী করলে তাঁর অনুসারিরা আমাদের উপর চড়াও হবে এবং তাঁকে ছাড়িয়ে নিবে।
নির্বাসিত করাও আমাদের জন্যে ক্ষতিকর।
কেননা, তখন মক্কার পার্শ্ববর্তী সকল আরব তাঁর চরিত্রমাধুর্য, মিষ্ট কথা-বার্তা এবং কোরআনের ভক্ত হয়ে যাবে।
তাঁরা সকলকে নিয়ে আমাদের উপর চড়াও হবে। আবু জাহ্ল রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হত্যা করার পরামর্শ দিল এবং বলল :
এ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যেক গোত্রের এক-এক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করবে, যাতে বনী আবদে-মানাফ প্রতিশোধ নিতে অক্ষম হয়ে পড়ে।
সকলেই এই পরামর্শ পছন্দ করল এবং প্রত্যেক গোত্রের এক একজন যুবককে এ কাজের জন্যে নিযুক্ত করল।
তারা হত্যাকাণ্ডের দিনক্ষণও ঠিক করে দিল যে, অমুক রাতে একাজ করতে হবে।
কিন্তু পয়গাম্বরগণের অদৃশ্য শক্তি সম্পর্কে এই মূর্খরা মোটেই অবগত ছিল না। এদিকে হযরত জিবরাঈল (আ.) তাদের পরামর্শসভার যাবতীয় কার্যবিবরণী সম্পর্কে
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অবহিত করে দিলেন।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে আত্মরক্ষার কৌশলও বলে দিলেন যে, আজ রাতে আপনি নিজ বিছানায় শয়ন করবেন না।
আল্লাহ্ আপনাকে মদীনায় হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেছেন।
এদিকে পরামর্শ অনুযায়ী সন্ধ্যা থেকেই কোরায়শী দুর্বৃত্তরা রাসূলে করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গৃহ অবরোধ করে রাখলো।
এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত আলীকে (রা.) আদেশ দিলেন : অদ্য রাতে তুমি আমার বিছানায় শয়ন করবে।
আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে এ সুসংবাদও দিলেন যে,
এতে বাহ্যত তোমার প্রাণনাশের আশংকা থাকলেও বাস্তবে শত্রুরা তোমার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না।
হযরত আলী (রা.) একাজের জন্যে সানন্দে নিজেকে পেশ করলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
কিন্তু এখন সম্মুখে এই সমস্যা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই নিদ্রিত অবরোধ থেকে কিভাবে বের হবেন? আল্লাহ্ তা’আলা একটি মোজেযার সাহায্যে এর সমাধান করলেন।
আর সেই মোজেযা তথা অলৌকিক ঘটনা ছিল এই যে, ঐশী আদেশে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মুষ্টি মাটি নিয়ে গৃহের বাইরে এলেন
এবং অবরোধকারীরা তাঁর সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা বলছিল, সেগুলোর জওয়াব দিলেন।
কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা তাদের দৃষ্টি ও চিন্তাকে তাঁর দিক থেকে ফিরিয়ে দিলেন।
ফলে, কেউ তাঁকে দেখল না। অথচ তিনি প্রত্যেকের মাথায় মাটি নিক্ষেপ করতে করতে চলে গেলেন।
তাঁর চলে যাওয়ার পর কোন এক আগন্তুক অবরোধকারীদের জিজ্ঞাসা করল, তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
তারা বলল : মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অপেক্ষায়। আগন্তুক বলল : তিনি তো এখান থেকে বের হয়ে চলেও গেছেন।
আর চলে যাওয়ার সময় তিনি তোমাদের প্রত্যেকের মাথায় মাটি নিক্ষের করে গেছেন।
একথা শুনে তারা নিজেদের মাথায় হাত দিয়ে দেখল যে, বাস্তবিকই মাটি পড়ে আছে। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২য় খন্ড )
হযরত আলী (রা.) রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিছানায় শায়িত ছিলেন।
অবরোধকারীরা তাঁর পার্শ্ব পরিবর্তন দেখে বুঝে নিল যে, ইনি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নন। তাই হত্যার পদক্ষেপ নিল না।
সকাল পর্যন্ত অবরোধ করার পর তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে গেল।
এ রাত এবং এতে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্যে নিজেকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলা
হযরত আলী (রা.)-এর অন্যতম বিশেষ ফযীলত হিসেবে গণ্য।
আর স্বীয় পিতামহের এই অতুলনীয় ও বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ সম্পর্কে
আহ্লে বাইতের তৃতীয় প্রজন্মের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হযরত আলী ইবনুল হুসাইন (রাহ্.) বলেন :
عَنْ عَلِيِّ بْنِ الْحُسَيْنِ قَالَ : ্রإِنَّ أَوَّلَ مَنْ شَرَى نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍগ্ধ (مُسْتَدْرَك الحَاكِم فِيْ
كِتَابِ الهِجْرَةِ :
٤٢٦٤)
“ইসলামের ইতিহাসে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে সর্বপ্রথম নিজেকে উৎসর্গ করেন হযরত আলী (রা.)।” (মুস্তাদরাক হাকেম : ৪২৬৪)
মোটকথা ইসলামের সেই বৈরী সময়ে কোরায়েশ নেতাদের পরামর্শ সভায় যে তিনটি অভিমত
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যাপারে পেশ করা হয়েছিল,
সেগুলো কোরআন পাকের এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে :
وَإِذۡ يَمۡكُرُ بِكَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لِيُثۡبِتُوكَ أَوۡ يَقۡتُلُوكَ أَوۡ يُخۡرِجُوكَۚ وَيَمۡكُرُونَ وَيَمۡكُرُ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ (سُورَةُ الأَنفَالِ : ٣٠)
“সেই সময়টি স্মরণীয়, যখন কাফেররা আপনার বিরুদ্ধে কৌশল উদ্ভাবনে ব্যাপৃত ছিল, আপনাকে বন্দী করবে, অথবা হত্যা করবে অথবা, দেশান্তরিত করবে।
কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সকল কৌশল ব্যর্থ করে দিলেন।
আল্লাহ্ তা’আলাই শ্রেষ্ঠ কৌশল উদ্ভাবনকারী। তাঁর কৌশল সকল কৌশলকে পরাভুত করে দেয়।”
(সূরা আল আনফাল : ৩০)
সওর গিরিগুহায় অবস্থান
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত আবু বকর (রা.)-সহ পবিত্র মক্কা নগরীর
এক প্রান্তে অবস্থিত সওর পাহাড়ের একটি গুহায় যাত্রা-বিরতি করলেন।
এদিকে কোরায়েশ যুবকরা সকাল পর্যন্ত তাঁর বাইরে আসার অপেক্ষায় থাকে। অবশেষে তারা জানতে পারে যে,
বিছানায় মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবর্তে হযরত আলী (রা.) শুয়ে আছেন।
তখন হানাদার দল ভীষণ পেরেশান হয়ে চতুর্দিকে তাঁর অন্বেষণে বেরিয়ে পড়ে।
কাফেররা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে গ্রেফতার করার জন্যে এক’শ উট পুরস্কার ঘোষণা করে।
সেমতে অনেক মানুষ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সন্ধানে হন্যে হয়ে চতুর্দিকে বেরিয়ে পড়ল।
কতক অনুসন্ধান বিশারদ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঠিক সওর গিরিগুহার প্রান্তে পৌঁছে গেল।
যদি তারা সামান্য নুয়ে তাকাত, তবে পরিষ্কার রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে চোখের সামনেই দেখতে পেত।
তখন তাদের এই অতি নিকট উপস্থিতি দেখে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) চিন্তান্বিত হলেন।
রাসূলে করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : “চিন্তা করো না! আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে আছেন।” আর এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন :
إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدۡ نَصَرَهُ ٱللَّهُ إِذۡ أَخۡرَجَهُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ثَانِيَ ٱثۡنَيۡنِ
إِذۡ هُمَا فِي ٱلۡغَارِ إِذۡ يَقُولُ لِصَٰحِبِهِۦ لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ
فَأَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلَيۡهِ وَأَيَّدَهُۥ بِجُنُودٖ لَّمۡ تَرَوۡهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ٱلسُّفۡلَىٰۗ وَكَلِمَةُ ٱللَّهِ هِيَ ٱلۡعُلۡيَاۗ وَٱللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
(سُورَةُ التَّوۡبَةِ :
٤٠)
“যদি তোমরা তাঁকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো আল্লাহ্্ তাঁর সাহায্য করেছিলেন, যখন তাঁকে কাফেররা (মক্কা থেকে) বহিষ্কার করেছিল,
তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন।
তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, বিষণ্ণ হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।
অতঃপর আল্লাহ্্ তাঁর প্রতি স্বীয় সান্ত¡না অবতীর্ণ করলেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখনি।
বস্তুতঃ আল্লাহ কাফেরদের মাথা নীচু করে দিলেন আর আল্লাহর কথাই সদা সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আত্ তাওবাহ্ : ৪০)
গুহাসঙ্গী হযরত আবু বকর (রা.) নিজের জন্যে চিন্তিত ছিলেন না; কিন্তু তিনি ভয়গ্রস্থ ছিলেন এ কারণে যে, শত্রুরা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর হামলা করে বসতে পারে।
কেননা, তাদের পদাতিক ও অশ্বারোহীদল সকলেই তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আশ্রয়স্থলও কোন দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল না; একটি গুহা ছিল মাত্র, যে গুহার প্রান্ত পর্যন্ত অনুসন্ধানকারীরা পৌঁছে গিয়েছিল।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দৃঢ়তার পাহাড় হয়ে কেবল নিজেই নিরুদ্বিগ্ন ছিলেন না,
বরং সঙ্গী হযরত আবু বকর (রা.)-কে বলছিলেন : “চিন্তা করো না! আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে আছেন।”
এটা উচ্চারণে দুটি মাত্র বাক্য। কিন্তু পরিস্থিতির পূর্ণ চিত্র সামনে রেখে চিন্তা করলে বুঝতে কষ্ট হয় না যে,
নিছক বন্তুনিষ্ঠ চিন্তা-ভাবনাকারী থেকে এহেন প্রশান্তি ও স্বস্তি প্রকাশ পাওয়া সম্ভবপর নয়।
এর কারণ তাই, যা কোরআন পাক পরবর্তী বাক্যে এরশাদ করেছে, “আল্লাহ্ আপনার অন্তরে সান্তনা নাযিল করেছেন
এবং এমন বাহিনী দ্বারা আপনাকে সাহায্য করেছেন, যাদের আপনি দেখেননি।”
এই বাহিনী ফেরেশতাদেরও হতে পারে এবং সমগ্র বিশ্বের শক্তিও হতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে অবশেষে কুফর অবদমিত হয়েছে
এবং আল্লাহর বাণী উচ্চে সমাসীন হয়েছে।
(তাফসীরে মা’আরেফুল-কোরআন)
সওর গিরিগুহা থেকে মদীনা অভিমুখে যাত্রা
সওর গুহায় অবস্থানের তৃতীয় দিন রবিউল-আউয়াল মাসের সোমবার
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর মুক্ত ক্রীতদাস আমের ইবনে ফুহায়রা (রা.) দু’টি উট নিয়ে উপস্থিত হল।
এগুলো এ সফরের জন্যেই হযরত আবু বকর (রা.) সংগ্রহ করেছিলেন।
এগুলোর সাথে মজুরীর বিনিময়ে নিযুক্ত পথপ্রদর্শক হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উরাইকিত আল লাইসীও পৌঁছেন।
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক উটে সওয়ার হয়ে গেলেন। হযরত আবু বকর (রা.) অন্য উটে।
তিনি খেদমতের জন্যে হযরত আমের ইবনে ফুহায়রা (রা.)-কেও নিজের সাথে বসিয়ে নিলেন।
আবদুল্লাহ্ ইবনে উরাইকিত অগ্রে-অগ্রে পথ দেখিয়ে চলল।
(সীরাতে ইবনে হিশাম)
সুরাকা ইবনে মালেকের পথিমধ্যে পৌঁছানো
আবু ইসহাক হযরত বারা ইবনে আযেব (রা.) থেকে বর্ণনা করেন :
عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، قَالَ: سَمِعْتُ البَرَاءَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ
: “لَمَّا أَقْبَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى المَدِينَةِ تَبِعَهُ سُرَاقَة
بْنُ مَالِكِ بْنِ جُعْشُمٍ، فَدَعَا عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَاخَتْ بِهِ فَرَسُهُ قَالَ
: ادْعُ اللَّهَ لِي وَلاَ أَضُرُّكَ، فَدَعَا لَهُ”
(مُسْتَدْرَك الحَاكِم فِيْ كِتَابِ مَعْرِفَةِ الصَّحَابَةِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ : ٦٩٧٧)
“কোরায়েশদের প্রেরিত অনুসন্ধানকারীদের একজন সুরাকা ইবনে মালেক রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরছিল।
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাত্রার পর কিছুদূর অগ্রসর হলে, সে সেখানে পৌঁছে গেল।
নিকটে পৌঁছার পর তার ঘোড়া হোঁচট খেল এবং সুরাকা মাটিতে পড়ে গেল।
কিন্তু পূণরায় ঘোড়ায় চড়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পিছনে চলতে লাগলো। এক পর্যায়ে সে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পেল।
তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বার-বার পিছনে ফিরে সুরাকাকে দেখছিলেন।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার প্রতি ভ্রƒক্ষেপও করলেন না।
যখন সুরাকা আরও নিকটবর্তী হল, তখন তার ঘোড়ার পদ চতুষ্টয় শুষ্ক ও কঠিন হওয়া সত্তে¡ও মাটিতে হাঁটু পর্যন্ত দেবে গেল।
অতঃপর শত চেষ্টা করেও সে ঘোড়াকে উদ্ধার করতে সক্ষম হল না।
অবশেষে বাধ্য হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আশ্রয় প্রার্থনা করল।
তিনি থেমে গেলেন এবং তাঁর বরকতে ঘোড়া সেখান থেকে বের হয়ে এলো।”
(মুস্তাদরাক হাকেম : ৬৯৭৭, সীরাতে ইবনে-হিশাম)
ঘোড়ার পা মাটি থেকে বের হওয়ার পর পায়ের জায়গা থেকে ধোঁয়া উত্থিত হতে দেখা গেল।
ধোঁয়া দেখে সুরাকা আরও বেশি হতভম্ব হয়ে গেল।
সে নেহায়েত কাকুতি-মিনতি সহকারে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে পাথেয়, উপস্থিত আসবাবপত্র, উট ইত্যাদি পেশ করতে লাগল।
তিনি তা কবুল করলেন না এবং বললেন : তুমি যখন ইসলাম কবুল করছো না,
তখন এতটুকুই যথেষ্ট যে, তুমি আমাদের অবস্থান কাউকে বলবে না।
সুরাকা সেখান থেকে ফিরে এলো এবং নিরাপদ দূরত্বে না পৌঁছা পর্যন্ত এ ঘটনা কারও কাছে প্রকাশ করল না।
(সীরাতে-হালাবিয়া)
সুরাকার মুখে নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি : এই ঘটনার কিছুদিন পর সুরাকা আবু জাহ্লের কাছে
এই ঘটনা উল্লেখ করার পর কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করল,
যার অনুবাদ এরূপ : “হে আবুল হাকাম (আবু জাহল), লাতের কসম, (লাত একটি মূর্তি, কোরায়েশরা তার পূজা করত)
যদি তুমি ঘোড়ার মাটিতে দেবে যাওয়া প্রত্যক্ষ করতে,
তবে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে আল্লাহর রাসূল, সে বিষয়ে তোমার কোন সন্দেহ থাকত না।
আমার মতে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ থেকে নিজেরাও বেঁচে থাকা এবং অন্যকেও বিরত রাখা তোমার জন্যে অপরিহার্য।
কেননা, আমার বিশ্বাস কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সাফল্যের চিহ্ন এমনভাবে চমকে উঠবে যে,
সকল মানুষ বাসনা করবে, হায়! আমরা যদি তাঁর সাথে সন্ধি করে নিতাম!”
(সীরাতে-হালাবিয়া)
পবিত্র হিজরতের সূচনা পর্বে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রকাশিত একটি অলৌকিক ঘটনা
পবিত্র হিজরতের সূচনা পর্বে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রকাশিত
একটি অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে সাহাবী হযরত কায়েস ইবনে নোমান (রা.) বর্ণনা করেন :
عَنْ قَيْسِ بْنِ النُّعْمَانِ قَالَ : لَمَّا انْطَلَقَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبُو بَكْرٍ مُسْتَخْفِينَ مَرَّا بِعَبْدٍ يَرْعَى غَنَمًا، فَاسْتَسْقَيَاهُ
مِنَ اللَّبَنِ، فَقَالَ : مَا عِنْدِي شَاةٌ تُحْلَبُ غَيْرَ أَنَّ هَا هُنَا عَنَاقًا حَمَلَتْ أَوَّلَ الشِّتَاءِ، وَقَدِ أَخْدَجَتْ وَمَا بَقِيَ لَهَا لَبَنٌ، فَقَالَ :
্রادْعُ بِهَا فَدَعَا بِهَا، فَاعْتَقَلَهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَسَحَ ضَرْعَهَا، وَدَعَا حَتَّى أَنْزَلَتْ، قَالَ : وَجَاءَ أَبُو بَكْرٍ
رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ بِمِجَنٍّ فَحَلَبَ أَبَا بَكْرٍ، ثُمَّ حَلَبَ فَسَقَى الرَّاعِيَ، ثُمَّ حَلَبَ فَشَرِبَ، فَقَالَ الرَّاعِي : بِاللَّهِ مَنْ أَنْتَ فَوَاللَّهِ مَا
رَأَيْتُ مِثْلَكَ قَطُّ، قَالَ : ্রأَوَ تُرَاكَ تَكْتُمُ عَلَيَّ حَتَّى أُخْبِرَكَ؟গ্ধ قَالَ : نَعَمْ، قَالَ : ্রفَإِنِّي مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِগ্ধ فَقَالَ : أَنْتَ
الَّذِي تَزْعُمُ قُرَيْشٌ أَنَّهُ صَابِئٌ، قَالَ : ্রإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ ذَلِكَগ্ধ قَالَ : فَأَشْهَدُ أَنَّكَ نَبِيٌّ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مَا جِئْتَ بِهِ حَقٌّ، وَأَنَّهُ لَا
يَفْعَلُ مَا فَعَلْتَ إِلَّا نَبِيٌّ، وَأَنَا مُتَّبِعُكَ، قَالَ : ্রإِنَّكَ لَا تَسْتَطِيعُ ذَلِكَ يَوْمَكَ، فَإِذَا بَلَغَكَ أَنِّي قَدْ ظَهَرْتُ فَأْتِنَاগ্ধ هَذَا حَدِيثٌ
صَحِيحُ الْإِسْنَادِ، وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ” (مُسْتَدْرَك الحَاكِم فِيْ كِتَابِ الهِجْرَةِ :
٤٢٧٣)
“হিজরত করার সময় নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও হযরত আবু বকর (রা.) যখন গোপনে একটি উপত্যকা অতিক্রম করছিলেন,
তখন জনৈক রাখালকে সেখানে একপাল বকরী চরাতে দেখে বললেন, আমাদেরকে দুধ পান করাও।
রাখাল বলল, দুধ দোহন করা যায় এমন কোন বকরী আমার পালে নেই,
তবে একটি বাচ্চাওয়ালা বকরী ঐখানে বাধা আছে যে দুধ দেয়,
কিন্তু সেটির দুধও তার বাচ্চারা খেয়ে ফেলেছে।
রাখালের এ কথা শুনে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, সেই বকরীটি নিয়ে এসো। রাখাল বকরীটি নিয়ে আসার পর
আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বকরীর বাটে হাত বুলিয়ে দোয়া করার সাথে সাথে তা দুধে পূর্ণ হয়ে গেল।
অতঃপর হযরত আবু বকর (রা.) পাত্র নিয়ে দুধ দোহন করে পান করলেন।
এরপর রাখাল নিজেও দুধ দোহন করে পান করল। অতঃপর এই অবিশ্বাস্য ঘটনায় বিস্ময়াভিভূত হয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করল,
আল্লাহর দোহাই লাগে, বলুন আপনি কে?
তখন আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাখালকে বললেন,
যদি আমি আমার প্রকৃত পরিচয় দেই তাহলে তোমাকে তা গোপন রাখতে হবে।
রাখাল বলল, অবশ্যই আমি তা গোপন রাখবো। তখন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি মুহাম্মদ- আল্লাহর রাসূল।
এই পরিচয় পাওয়ার পর রাখাল বলল, আপনিই সেই ব্যক্তি, কোরাইশরা যাকে উন্মাদ বলে!
একথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, কোরাইশরা আমার সম্পর্কে এমনটিই বলে থাকে।
রাখাল তখন বলল, কিন্তু আমি এ মর্মে স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল।
সেই সাথে এও স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি যা কিছু নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন তা সত্য।
কারণ, কিছুক্ষণ পূর্বে আপনি যা করে দেখালেন, তা নবী ব্যতিত অন্য কেউ করতে সক্ষম নয়।
অতঃএব আমি আপনার উপর ঈমান এনে আপনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হতে চাই।
তখন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাখালের এই ভক্তিপূর্ণ আবেগ দেখে বললেন,
এখন এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তুমি আমার সঙ্গী হতে পারবে না,
তবে অদূর ভবিষ্যতে আমি যখন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করব তখন তুমি আমার সঙ্গী হতে পারবে।”
(মুস্তাদরাক হাকেম, কিতাবুল হিজরাহ্ : ৪২৭৩)
হিজরতকালীন বেদুঈন রমনী হযরত উম্মে মা’বাদের তাবুতে সংঘটিত মু’জিযা
পথিমধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর হিজরতের সফরসঙ্গীগণ
উম্মে মা’বাদ (বিনতে খালেদ) নামের এক মহিলার তাবুর কাছ দিয়ে গমন করলেন।
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত হিযাম ইবনে হিশাম (রাহ্.) তার পিতা সাহাবী হযরত হিশাম ইবনে হুবাইশ ইবনে খুয়াইলিদ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন :
عَنْ حِزَامِ بْنِ هِشَامٍ، عَنْ أَبِيهِ هِشَامِ بْنِ حُبَيْشِ بْنِ خُوَيْلِدٍ صَاحِبِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ مِنْ مَكَّةَ مُهَاجِرًا إِلَى الْمَدِينَةِ، وَأَبُو بَكْرٍ رَضِيَ
اللَّهُ عَنْهُ، وَمَوْلَى أَبِي بَكْرٍ عَامِرُ بْنُ فُهَيْرَةَ، وَدَلِيلُهُمَا
اللَّيْثِيُّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ أُرَيْقِطٍ مَرُّوا عَلَى خَيْمَتِيْ أُمِّ مَعْبَدٍ الْخُزَاعِيَّةِ،
وَكَانَتِ امْرَأَةً بَرْزَةً جَلْدَةً تَحْتَبِي بِفِنَاءِ الْخَيْمَةِ، ثُمَّ تَسْقِي
وَتُطْعِمُ، فَسَأَلُوهَا لَحْمًا وَتَمْرًا لِيَشْتَرُوا مِنْهَا، فَلَمْ يُصِيبُوا عِنْدَهَا شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ، وَكَانَ الْقَوْمُ مُرْمِلِينَ مُسْنِتِينَ، فَنَظَرَ رَسُولُ
اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى شَاةٍ فِي كَسْرِ الْخَيْمَةِ، فَقَالَ :
্রمَا هَذِهِ الشَّاةُ يَا أُمَّ مَعْبَدٍ؟গ্ধ قَالَتْ : شَاةٌ خَلَّفَهَا الْجَهْدُ عَنِ الْغَنَمِ، قَالَ : ্রهَلْ بِهَا مِنْ لَبَنٍ؟গ্ধ قَالَتْ : هِيَ أَجْهَدُ مِنْ ذَلِكَ،
قَالَ : ্রأَتَأْذَنِينَ لِي أَنْ أَحْلُبَهَا؟গ্ধ قَالَتْ : بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي، إِنْ
رَأَيْتَ بِهَا حَلْبًا فَاحْلُبْهَا، فَدَعَا بِهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
فَمَسَحَ بِيَدِهِ ضَرْعَهَا، وَسَمَّى اللَّهُ تَعَالَى، وَدَعَا لَهَا فِي شَاتِهَا، فَتَفَاجَّتْ عَلَيْهِ وَدَرَّتْ،
فَاجْتَرَّتْ فَدَعَا بِإِنَاءٍ يَرْبِضُ الرَّهْطُ فَحَلَبَ فِيهِ ثَجًّا حَتَّى عَلَاهُ الْبَهَاءُ، ثُمَّ سَقَاهَا حَتَّى رَوِيَتْ
وَسَقَى أَصْحَابَهُ حَتَّى رَوَوْا وَشَرِبَ آخِرَهُمْ حَتَّى أَرَاضُوا،
ثُمَّ حَلَبَ فِيهِ الثَّانِيَةَ عَلَى هَدَّةٍ حَتَّى مَلَأَ الْإِنَاءَ، ثُمَّ غَادَرَهُ عِنْدَهَا، ثُمَّ بَايَعَهَا وَارْتَحَلُوا عَنْهَا،
فَقَلَّ مَا لَبِثَتْ حَتَّى جَاءَهَا
زَوْجُهَا أَبُو مَعْبَدٍ لِيَسُوقَ أَعْنُزًا عِجَافًا يَتَسَاوَكْنَ هُزَالًا مُخُّهُنَّ
قَلِيلٌ، فَلَمَّا رَأَى أَبُو مَعْبَدٍ اللَّبَنَ أَعْجَبَهُ، قَالَ :
مِنْ أَيْنَ لَكِ هَذَا يَا أُمَّ مَعْبَدٍ وَالشَّاءُ عَازِبٌ حَائِلٌ، وَلَا حلوبَ فِي الْبَيْتِ؟ قَالَتْ : لَا وَاللَّهِ إِلَّا أَنَّهُ مَرَّ بِنَا رَجُلٌ مُبَارَكٌ مِنْ
حَالِهِ كَذَا وَكَذَا، قَالَ : صِفِيهِ لِي يَا أُمَّ مَعْبَدٍ، قَالَتْ : رَأَيْتُ رَجُلًا ظَاهِرَ
الْوَضَاءَةِ، أَبْلَجَ الْوَجْهِ، حَسَنَ الْخَلْقِ، لَمْ تَعِبْهُ ثَجْلَةٌ، وَلَمْ تُزْرِيهِ صَعْلَةٌ،
وَسِيمٌ قَسِيمٌ، فِي عَيْنَيْهِ دَعِجٌ، وَفِي أَشْفَارِهِ وَطَفٌ، وَفِي صَوْتِهِ صَهَلٌ،
قَالَ أَبُو مَعْبَدٍ : هَذَا وَاللَّهِ صَاحِبُ قُرَيْشٍ الَّذِي ذُكِرَ لَنَا مِنْ أَمْرِهِ مَا ذُكِرَ
، وَلَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ أَصْحَبَهُ،
وَلَأَفْعَلَنَّ إِنْ وَجَدْتُ إِلَى ذَلِكَ سَبِيلًا، وَأَصْبَحَ صَوْتٌ بِمَكَّةَ عَالِيًا يَسْمَعُونَ الصَّوْتَ، وَلَا يَدْرُونَ مَنْ صَاحِبُهُ وَهُوَ يَقُولُ :
جَزَى اللَّهُ رَبُّ النَّاسِ خَيْرَ جَزَائِهِ … رَفِيقَيْنِ حَلَّا خَيْمَتَيْ أُمِّ مَعْبَدِ
هُمَا نَزَلَاهَا بِالْهُدَى وَاهْتَدَتْ بِهِ … فَقَدْ فَازَ مَنْ أَمْسَى رَفِيقَ مُحَمَّدِ )اَلْمُسْتَدْرَك عَلَى الصَّحِيْحَيْنِ، كِتَابُ الْهِجْرَةِ : ٤٢٧٤(
“মক্কা মুকাররামা থেকে মদীনা মুনাওয়ারার উদ্দেশে হিজরত করার সময় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফর সঙ্গী ছিলেন মোট তিনজন।
হযরত আবু বকর (রা.), তাঁর ক্রীতদাস হযরত আমের ইবনে ফুহাইরা (রা.) ও পথ প্রদর্শক আবদুল্লাহ্ ইবনে উরাইকিত আল লাইসী (রা.)।
মক্কা মুকাররামা থেকে আনুমানিক এক’শ আশি মাইল পথ অতিক্রম করার পর তাঁরা জনমানবহীন এক উপত্যকায় অদূরে একটি তাবু দেখতে পেলেন,
যা সীরাতের কিতাবে ‘হযরত উম্মে মাবাদ’ এর তাবু নামে সমধিক প্রসিদ্ধ।
সেই মহীয়সী নারীর তাবু অতিক্রমকালে তাঁরা দেখতে পেলেন যে, তাবুর ছায়ায় এক নারী
সামান্য কিছু খাবার সামনে নিয়ে বসে পানাহার করছে।
অতএব কাফেলার লোকেরা এগিয়ে এসে ঐ নারীর কাছে গোশত ও খেজুর কিনতে চাইলে পর সে বিনয়ের সাথে জানালো যে,
তার কাছে বিক্রি করার মত কিংবা মুসাফিরদের আপ্যায়ন করার মত কোন খাদ্য-সামগ্রী মওজুদ নেই।
এদিকে কাফেলার লোকগুলো ছিল ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। আর তখনি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
তাবুর এক কোণে একটি বকরীর বাচ্চা বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে উম্মে মাবাদ!
এই বকরীটি কি দুধ দেয় না?
উম্মে মাবাদ বললেন, এটি এতো দুর্বল যে, দুধ দেয়া তো দূরের কথা, অন্য বকরীর সাথে চরে বেড়াতেও অক্ষম হয়ে পড়েছে।
তাই এটিকে তাবুতে রেখেই আমার স্বামী আবু মাবাদ অন্য বকরীগুলো নিয়ে অদূরে কোথাও চরাতে গেছেন।
একথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি অনুমতি দিলে আমি এটি দোহন করে দেখতে পারি কি?
সৌম্য-শান্ত সুদর্শন এই আগন্তুককে প্রথম দেখাতেই উম্মে মাবাদ চমৎকৃত হয়েছিলেন,
এখন তাঁর একথায় তিনি রীতিমত বিস্ময়াভিভূত হয়ে বললেন, আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হোক!
যদি আপনি মনে করেন যে, এর থেকে দুধ দোহন করতে পারবেন,
তবে অবশ্যই চেষ্টা করে দেখুন! অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ দুর্বল বকরীটি তাঁর কাছে আনতে বললেন
এবং ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে বকরীর স্তনে কয়েকবার হাত বুলালেন ফলে দেখতে দেখতে
শুকনো ও দুর্বল সেই বকরীর স্তন দুধে পূর্ণ হয়ে উঠলো।
অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুধ দোহন করার জন্য পাত্র চাইলে পর বড় একটি পাত্র আনা হলো
এবং হযরত আবু বকর (রা.)-এর ক্রীতদাস হযরত আমের ইবনে ফুহাইরা (রা.)-কে দুধ দোহন করতে বলা হলো।
তিনি দোহন করে পাত্র পূর্ণ করলেন। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুধ পান করলেন।
অতঃপর পূণরায় দোহন করার নির্দেশ দিলেন। এ
বারও দেখতে দেখতে কয়েক মুহুর্তের মধ্যে পাত্র দুধে পূর্ণ হয়ে গেলো।
একে একে উপস্থিত সকলেই তৃপ্তি সহকারে দুধ পান করলেন।
এরপর আবার দোহন করে দুধ দ্বারা পাত্র পূর্ণ করে (আবু মা’বাদের জন্য) রেখে দেয়া হলো।
এরপর কাফেলা যথারীতি উম্মে মা’বাদের তাবু থেকে বিদায় নিয়ে উদ্দিষ্ট পথে যাত্রা শুরু করল।
এর কিছু সময় পর আবু মা’বাদ ছাগল পাল নিয়ে তাবুতে ফিরে এলেন। তাবুর এক কোণে পাত্র পূর্ণ দুধ দেখে
আবু মা’বাদ বিস্মিত কণ্ঠে স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, হে উম্মে মা’বাদ! এই দুধ কোত্থেকে এলো?
অথচ তাবুতে দুধ দেয়ার মত কোন বকরী ছিল না। কেননা, একটি মাত্র রুগ্ন বকরী তিনি রেখে গিয়েছিলেন,
যেটি এতটাই শুকনো ও দুর্বল যে, হাটা-চলা করতেও অক্ষম- তাই সেটিকে তাবুতে রেখে গিয়েছিলেন।
আর এই রুগ্ন বকরী থেকে এক ফোটা দুধ পাওয়ার কল্পনাও কেউ করতে পারে না! তখন উম্মে মা’বাদ সেই মোবারক কাফেলার তার তাবুতে আগমন ও বিদায় নেয়া পর্যন্ত আদ্যপান্ত ঘটনা আবু মাবাদকে বর্ণনা করলেন।
উম্মে মা’বাদ বললেন : একজন অত্যন্ত ভদ্র ও সভ্রান্ত যুবক আজ আমাদের গৃহে কিছুক্ষণের জন্যে মেহ্মান হয়েছিলেন।
এগুলো সব তাঁর হাতের বরকত।
স্বামী মনোযোগ সহকারে স্ত্রীর মূখের বর্ণনা শোনার পর উচ্ছসিত হয়ে বললেন : হে উম্মে
মা’বাদ! আল্লাহর কসম, এই আগন্তুকই সেই প্রতিশ্রুত মহাপুরুষ- যাঁর আগমনের
মুহ‚র্তটির জন্যে সমগ্র বিশ্ব উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় ছিল।
যিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যে ত্রাণকর্তারূপে প্রেরিত হয়েছেন।
স্বামীর মুখে এ কথা শুনে হযরত উম্মে মা’বাদ বললেন : তুমি সত্যিই বলেছো, কেননা তিনি যখন দূর থেকে আমাদের তাবুর দিকে এগিয়ে আসছিলেন
তখন তাঁকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল, তপ্ত মরুভ‚মিতে একখন্ড শীতল মেঘ যেন এগিয়ে আসছে।
তাঁর পবিত্র চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও উজ্জল ও সুন্দর ছিল।
তিনি এগিয়ে আসার পর যখন আমাদের তাবুর সামনে দাঁড়ালেন তখন মনে হচ্ছিল যে,
তাবুর চারপাশ যেন এক স্বর্গীয় আলোয় আলোকিত হয়ে গেল।
উম্মে মা’বাদ কর্তৃক নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবয়ব সম্পর্কে
বর্ণিত সেই বিখ্যাত ও দীর্ঘ কবিতার সূচনা-পর্বের দুটি চরণ ছিল নিম্নরূপ :
جَزَى اللَّهُ رَبُّ النَّاسِ خَيْرَ جَزَائِهِ … رَفِيقَيْنِ حَلَّا خَيْمَتَيْ أُمِّ مَعْبَدِ
هُمَا نَزَلَاهَا بِالْهُدَى وَاهْتَدَتْ بِهِ … فَقَدْ فَازَ مَنْ أَمْسَى رَفِيقَ مُحَمَّدِ
“মানুষের প্রভু সর্বদা মানুষকে উত্তম প্রতিদানই দিয়ে থাকেন।
যেমনটি তিনি দেখিয়েছেন ঐ দুই সঙ্গীর বেলায়- যারা উম্মে মাবাদের তাবুতে আগমন করেছিলেন।
সৌম্যকান্ত সেই পথচারীদ্বয় উম্মে মাবাদের তাবুতে আগমন করেছিলেন হিদায়াতের আলো নিয়ে,
তাই তাবুর অধিবাসীর হৃদয় মুহুর্তেই সে আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। আর যে মুহাম্মদের সংস্পর্শে আসে সে এভাবেই সফলকাম হয়ে যায়।”
উল্লেখ্য যে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শানে রচিত উম্মে মাবাদের সেই কবিতা অচিরেই সমগ্র আরবে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়।
এক রেওয়ায়াতে আছে, এরপর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই হিজরত করে মদীনায় পৌঁছে যায় এবং ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়।
(মুস্তাদরাক হাকেম : ৪২৭৪, সীরাতে ইবনে-হিশাম : ৪র্থ খন্ড)
(চলবে)